সুপ্রাচীন ও ঐতিহাসিক মসজিদগুলো সারা বিশ্বের নিকট বাংলাদেশ ও ইসলামের সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিচায়ক। তাছাড়া এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোর আবেগও এই স্থাপনাগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কিত এই প্রতিবেদনে আসুন আমরা ঘুরে আসি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ৫টি মসজিদে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ,খুলনা:
বাংলা সালতানাতের সময় সুন্দরবনের গভর্নর খান জাহান আলী এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভগুলোর মধ্যে একটি। সাতটি সারিতে সাজানো ৭৭ নিচু গম্বুজ এবং প্রতিটি কোণে একটি করে গম্বুজ নিয়ে মোট গম্বুজ সংখ্যা ৮১টি। এখানকার চারটি টাওয়ারের মধ্যে আযান দেয়ার জন্য দুটি ব্যবহার করা হত। বিস্তীর্ণ নামাযের জায়গায় ২১টি কাতারে একসাথে প্রায় তিন হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। ৬০টি সরু পাথরের স্তম্ভ গম্বুজগুলোকে ধরে রাখে। এই কারণেই মূলত একে ষাট গম্বুজ মসজিদ বলা হয়ে থাকে।
বাঘা মসজিদ,রাজশাহী:
বাঘা উপজেলায় অবস্থিত ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ। রাজশাহী জেলা সদর হতে প্রায় ৪১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এ মসজিদটি অবস্থিত। সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। মসজিদটি ১৫২৩-১৫২৪ সালে (৯৩০ হিজরি) হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন শাহের পুত্র সুলতান নুসরাত শাহ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই মসজিদের সংস্কার করা হয় এবং মসজিদের গম্বুজগুলো ভেঙ্গে গেলে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদে নতুন করে ছাদ দেয়া হয় ১৮৯৭ সালে।
মসজিদটি ২৫৬ বিঘা জমির ওপর অবস্থিত। সমভুমি থেকে থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু করে মসজিদের আঙিনা তৈরি করা হয়েছে। উত্তর পাশের ফটকের ওপরের স্তম্ভ ও কারুকাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মসজিদটিতে ১০টি গম্বুজ আছে আর ভেতরে রয়েছে ৬টি স্তম্ভ। মসজিদটিতে ৪টি মেহরাব রয়েছে যা অত্যন্ত কারুকার্য খচিত। দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট প্রস্থ ৪২ ফুট, উচ্চতা ২৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেয়াল চওড়া ৮ ফুট গম্বুজের ব্যাস ৪২ ফুট, উচ্চতা ১২ ফুট। চৌচালা গম্বুজের ব্যাস ২০ ফুট উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। মাঝখানের দরজার ওপর ফার্সি ভাষায় লেখা একটি শিলালিপি রয়েছে। মসজিদটিতে সর্বমোট ১০টি গম্বুজ, ৪টি মিনার (যার শীর্ষদেশ গম্বুজাকৃতির) এবং ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। বাঘা মসজিদটির গাঁথুনি চুন এবং সুরকি দিয়ে। মসজিদের ভেতরে এবং বাইরের দেয়ালে সুন্দর মেহরাব ও স্তম্ভ রয়েছে। এছাড়া আছে পোড়ামাটির অসংখ্য কারুকাজ যার ভেতরে রয়েছে আমগাছ, শাপলা ফুল, লতাপাতাসহ ফার্সি খোদাই শিল্পে ব্যবহৃত হাজার রকম কারুকাজ। এছাড়া মসজিদ প্রাঙ্গণের উত্তর পাশেই রয়েছে হজরত শাহদৌলা ও তার পাঁচ সঙ্গীর মাজার। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসাইন শাহর পুত্র নাসিরউদ্দীন নসরত শাহ জনকল্যাণার্থে মসজিদের সামনেই একটি দিঘী খনন করেন।
খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, ঢাকা:
মুঘল শাসক নায়েব নাজিমের শাসনামলে কাজী আবদুল্লাহর নির্দেশে ১৭০৪ থেকে ১৭০৫ সালে খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদটি নির্মাণ করেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি মাটি থেকে প্রায় ১৭ ফুট উঁচু একটি মঞ্চের ওপর নির্মিত। চারটি মিনারের এই অপূর্ব মসজিদটি যেন আজও মুঘল আভিজাত্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। লালবাগ কেল্লা থেকে মাত্র আধ-কিলোমিটার দূরে প্রাচীর ঘেরা এই মসজিদটি লালবাগ কেল্লার গাম্ভীর্যের প্রতিকৃতি।
সাত গম্বুজ মসজিদ, ঢাকা:
গভর্নর শায়েস্তা খান দ্বারা নির্মিত সাত গম্বুজ মসজিদ ঢাকার উত্তর-পশ্চিম উপকণ্ঠে মোহাম্মদপুর এলাকায় অবস্থিত। এটি ১৭ শতকে বাংলাদেশে প্রবর্তিত প্রাদেশিক মুঘল স্থাপত্যশৈলীর একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। মসজিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর নামাযের জায়গাকে আচ্ছাদিত করে সাতটি গম্বুজাকার মুকুট।
মাটি থেকে এর উচ্চতা ১৫ ফুট। সাত গম্বুজ মসজিদের বাইরের অংশটি ঢাকা মুঘল আমলের সমস্ত স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে সবচেয়ে উদ্ভাবনী। মিহরাবের অলঙ্করণগুলো হাজী খাজা শাহবাজের মসজিদে মিহরাবের অলঙ্করণের কথা মনে করিয়ে দেয়। নামাযের ঘরটির উপর সাধারণ তিনটি গম্বুজ ছাড়াও, চারটি ফাঁপা দ্বি-গম্বুজ বিশিষ্ট টাওয়ার রয়েছে, যার জন্য এর নাম সাত গম্বুজ মসজিদ হয়েছে। মসজিদের ইট-চুনের দেয়ালগুলো ৬ ফুট গভীর।
ছোট সোনা মসজিদ, নওয়াবগঞ্জ:
এই মসজিদটি সুলতান হোসেন শাহের আমলে ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ সালে ওয়ালী মাহমুদ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে। সেই সময়ে বেশ রাজকীয় নগরী গৌড়ে নির্মিত হয়েছিল এই মসজিদটি। চারটি দেয়ালই বাহ্যিকভাবে এবং কিছুটা অভ্যন্তরীণভাবেও গ্রানাইট পাথরের খণ্ড দিয়ে সাজানো। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে পরে সংরক্ষণ কাজের ফলে এই পাথরগুলো পশ্চিম প্রাচীরের দক্ষিণ দিক থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। মসজিদের অভ্যন্তরে মোট পনেরটি ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি আয়তক্ষেত্রাকার ইউনিট চৌচালা ভল্ট দিয়ে আচ্ছাদিত এবং বাকি বারোটি বর্গাকার ইউনিট প্রতিটি গম্বুজ দ্বারা আবৃত।