ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার আহসান মঞ্জিল। এই নান্দনিক স্থানটিতে প্রতিদিনই থাকে দর্শনার্থীদের ভিড়। এক সময় এটি ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ ছিল। ১৮৭২ সালে নওয়াব আবদুল গনি তাঁর পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামে ‘আহসান মঞ্জিল’ নামকরণ করেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত এই প্রাসাদটি বাংলার একটি প্রধান রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল।
প্রাসাদ ভবনটি আবার দুটি অংশে বিভক্ত। মাঝখানে গোলাকার কক্ষের উপর অষ্টকোন বিশিষ্ট উচু গম্বুজটি অবস্থিত। পূর্বাংশে দোতলায় বৈঠকখানা, গ্রন্থাগার, কার্ডরুম ও তিনটি মেহমান কক্ষ রয়েছে। এবং পশ্চিমাংশে রয়েছে একটি নাচঘর ও কয়েকটি আবাসিক কক্ষ। আহসান মঞ্জিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল দোতলা থেকে সরাসরি প্রাসাদের আঙ্গিনায় নামার সুপ্রশস্ত সিঁড়ি যা বুড়িগঙ্গার দিকে অবস্থিত। সকল বয়সের দর্শনার্থী এখানে ছবি তোলেন এবং বাচ্চাদের আনন্দে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে দেখা যায়।
নিচতলায় পূর্বাংশে রয়েছে ডাইনিং হল, পশ্চিমাংশে বিলিয়ার্ড কক্ষ, দরবার হল ও কোষাগার। প্রাসাদ ভবনের উভয় তলায় উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে সুপ্রশস্ত বারান্দা। আহসান মঞ্জিলের ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টি কক্ষ বিভিন্ন প্রদর্শনীর জন্য, নয়টি কক্ষ লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে প্রাপ্ত ফ্রিৎজকাপ কর্তৃক ১৯০৪ সালে তোলা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে সাজানো হয়েছে। আহসান মঞ্জিলের তোষাখানা কোকারিজ কক্ষে থাকা তৈজসপত্র এবং নওয়াব এস্টেটের পুরানো অফিস এডওয়ার্ড হাউস থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষণ করে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা চার হাজার সাতটি।
এখানে ঘুরতে আসলে দর্শনার্থীরা নবাবি আমলের অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন। নবাবদের সময়ে ঢাকায় ফিল্টার করা পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়। নবাব ‘আব্দুল গনি’ আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকা শহরে ফিল্টার করা পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন। নবাবদের অবদানে ঢাকায় প্রথম চালু হয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। সাড়ে চার লাখ টাকা ব্যয়ে তিনি এ বিজলি বাতির ব্যবস্থা করেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আহসান মঞ্জিলের এ জায়গায় একটি রংমহল ছিল। যা নির্মাণ করেন তখনকার জমিদার শেখ এনায়েত উল্লাহ। তার ছেলে মহলটি ফরাসি বণিকের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছ থেকে আবার এটি কিনে নেন। তার ছেলে নওয়াব আবদুল গণি ১৮৫৯ সালে এখানে আহসান মঞ্জিলের নির্মাণ শুরু করেন। কাজটি শেষ হয় ১৮৭২ সালে। ১৮৯৭ সালের এক টর্নেডোয় ভবনটির অনেক ক্ষতি হলে নবাব আহসানুল্লাহ তা সংস্কার করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে এখানে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়।
জমিদারি উচ্ছেদ আইনে ১৯৫২ সালে ঢাকার নবাব এস্টেট তৎকালীন সরকার অধিগ্রহণ করে। নবাব পরিবারের সম্পত্তির মধ্যে অধিগ্রহণ বহির্ভূত ছিল আহসান মঞ্জিল ও তৎসংলগ্ন আঙিনা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নবাব পরিবারের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা প্রায় সবাই বিদেশে পাড়ি জমান। এ দেশে যারা ছিলেন তারা বিরাট এ প্রাসাদ ভবনের রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষম ছিলেন না। ফলে এটি ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে। ১৯৭৪ সালে নবাব পরিবারের উত্তরসূরিরা আহসান মঞ্জিল নিলামে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভবনটির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন করেন। ১৯৭৪ সালের ২ নভেম্বর প্রাসাদ ভবনটি নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। এরপর সংস্কার করে এখানে জাদুঘর ও পর্যটনকেন্দ্র স্থাপনের নির্দেশ দেন তিনি।
১৯৮৫ সালের ৩ নভেম্বর আহসান মঞ্জিল প্রাসাদ ও তৎসংলগ্ন চত্বর সরকার অধিগ্রহণ করে সেখানে জাদুঘর স্থাপনের কাজ শুরু করে। ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর আহসান মঞ্জিল জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ঢাকার কয়েক শ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে আছে এই স্থাপনাটি।