মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, এডভোকেট॥
আমি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলাম না, এখনও নই, ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভাবনা নাই। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হল নিজেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি, জাসদ ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ ভক্তি, আসক্তি বা সমর্থনের উর্ধ্বে রেখে সব কিছুকে নিরপেক্ষভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করার ব্যক্তিগত ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখা। আমি ৩ অক্টোবর ১৯৯১ পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালন করার সময় থেকে মনে প্রাণে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছি। ঐ সাল থেকেই দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় ’অতিথি কলাম’ লেখা শুরু করেছি। লেখা যাতে সত্য ও নিরপেক্ষ হয় তার চেষ্টা করেছি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার অর্থ নিজের বিবেক-মস্তক দলের কাছে এক ধরনের বন্ধক দেওয়া। দল কোন অবৈধ,অন্যায়,অসত্য সিদ্ধান্ত নিলেও আমি দলের সদস্য হিসেবে তা মানতে বাধ্য। নীতিগতভাবে পদত্যাগ না করে দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোন বক্তব্য মৌখিক বা লিখিতভাবে প্রকাশ করতে পারি না। আমি ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সাল থেকে নিরবিচ্ছিন্নভাবে ফৌজদারী বা অপরাধবিষয়ক আইন পেশায় জড়িত আছি। যা আমার মরহুম পিতা এডভোকেট ফজলুল করিমের ধারাবাহিকতা বা ইচ্ছার প্রতিফলন বলা যায়। আমি নিজেও একজন নিয়মিত পাঠক। আমি পত্রপত্রিকায় কোন লেখা/কলাম পড়ার আগে লেখক কে দেখি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত ইত্যাদি দলের অন্ধ সমর্থক হিসেবে ব্র্যান্ডেড বা পরিচিত লেখকের লেখা পড়ি না, পড়লেও শেষে পড়ি। আগে পড়ি যাদের নিরপেক্ষভাবে সত্য কথার লেখক ও বিশ্লেষক হিসেবে পরিচিতি আছে তাদের লেখা।
আমি ১৯৭১ এর একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলাম। তবে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বা সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম না। সুযোগ থাকা সত্তে¡ও সনদধারী মুক্তিযোদ্ধা হই নাই। কারণ তা করলে শহীদ আবদুল হামিদ ভাইয়ের মত অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের প্রতি, যুদ্ধাহত ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অসম্মান,অবিচার করা হবে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেছি। ২০২৪ সালের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামেও আমি নিজে,দেশে বিদেশে অবস্থানরত ছেলে-মেয়ে ও নাতিও প্রত্যক্ষপরোক্ষ অংশগ্রহনকারী ও সমর্থক। ১৯৭১ সালে দল মত নির্বিশেষে লাখ লাখ (বঙ্গবন্ধুর মতে ত্রিশ লাখ, পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের মতে তিন লাখ শহীদ হয়েছেন) বীর বাঙ্গালী রক্ত দিয়ে দলখদার পাকিস্তানী বাহিনীকে আমাদের মাটিতে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছি। তখন ভারতও পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের স্বার্থে। অবশ্যই একই সাথে ভারতীয় বাহিনীর যুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে তরান্বিত করেছে, সহজ করেছে। ভারত বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্ধেরা গান্ধীর সরকার আমাদের ভারতের মাটিতে আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য দিয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, স্বীকৃতি দিয়ে, দেশে-বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে সাহায্য করেছে তা আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে সব সময় স্মরণ করি। তখন কিন্তু প্রায় এক কোটি বাংগালী (পূর্ব পাকিস্তানী) ইন্ধিরা গান্ধী হিন্দু বলে তার সরকারের দেয়া আশ্রয়,খাদ্য, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, স্বীকৃতি ইত্যাদি গ্রহন করতে দ্বিমত করি নাই।
ছলে, বলে, কৌশলে ২০১৪,২০১৮ ও ২০২৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের নামে জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকার অস্বীকার করে জেল, জুলুম, হত্যা, গুমের মাধ্যমে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরী করে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বিগত ১৫ বছরের অধিক কাল ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন। ভারতের মোদি সরকার তা প্রকাশ্যে সমর্থন করেছে বলে আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা ভারত সরকারের ওপর চরম অসন্তোষ্ট। ছাত্রদের কোটাবিরোধী মাত্র এক মাসের আন্দোলনের ফলে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। স্বৈরাচারের অনুগত বাহিনীর র্নিবিচার গুলি বর্ষণে ৯৩জন শিশু সহ প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হন, শহীদ হন। গণপিটুনিতে প্রায় ৫৪জন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার খবরও প্রকাশ হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই নি¤œ পদের বলে জানা যায়। প্রতিদিন পতিত প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা, ১৪ দলীয় জোট নেতা, সাংবাদিক, ক্রিড়াবিদসহ স্বৈরাচারের দোসরদের অভিযুক্ত করে শত শত আসামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এতে পক্ষে-বিপক্ষে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। দিনে দুপুরে শত শত মানুষ হত্যা যারা করেছেন,যাদের আদেশে হত্যা করেছেন তাদের অবশ্যই বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। মামলাগুলো অবশ্যই আইনতঃ গ্রহনযোগ্য,বিশ্বাসযোগ্য, স্বাভাবিক ও ন্যায় বিচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে করতে হবে। প্রতিটি মামলার ঘটনা সত্য অর্থাৎ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। যাদের আদেশে হত্যা করা হয়েছে,যারা হত্যা করেছে,যারা সহযোগিতা করেছে তাদের নামও আসামী হিসেবে এজাহারে দেওয়া হয়েছে। তবে সত্য ঘটনার জন্য দায়ী আসামীদের সাথে অসংখ্য নির্দোষ লোককেও আসামী করা হচ্ছে বলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে কোন ঘটনা হয় নাই,অথচ মিথ্যা,বানোয়াট ঘটনা দেখিয়ে শত শত সম্পূর্ণ নির্দোষ লোককে আসামী করে এজাহার দায়ের করা হয়েছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ বাদী হয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন, আসামী করা হয়েছে বিএনপি, জামাত বা স্বৈর সরকারের সমালোচনাকারীদের। পুলিশ বাদী, পুলিশ তদন্তকারী কর্মকর্তা। সুতরাং অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
আদালতও তা গ্রহন করেছেন। আসামী গ্রেপ্তার হচ্ছেন, আত্মসমর্পণ করছেন, হাজতে যাচ্ছেন, পরে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পাচ্ছেন। বছরের পর বছর আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন সম্পূর্ণ নির্দোষ আসামীরা হাজার হাজার মামলায়। মামলার বিচার শেষ হচ্ছে না। আমাদের এই অ লে সত্য ঘটনায় প্রকৃত আসামীর সাথে নির্দোষ মানুষকেও হয়রানী করার কুমানসে আসামী দেওয়ার প্রবণতা আছে। আমি পাবলিক প্রসিকিউটর থাকা কালে তিন বছরের মামলা নিয়ে গবেষণা করে দেখেছি শাস্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যেও এজাহারের মাত্র শতকরা ১৮জন আসামী দোষী সাব্যস্থ হয়ে দন্ডিত হয়েছেন,বাকী শতকরা ৮২জন আসামী বেকসুর খালাস বা অব্যাহতি পেয়েছেন। এখনও মনে হচ্ছে নির্দোষ মানুষকেও আসামী করা হচ্ছে। বেশী আসামী করলে অসুবিধা হল বিচারের সময় ’বেনিফিট অব ডাউট’ বা সন্দেহের কারণে সকল আসামী খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকে সব সময়। আইনের প্রতিষ্ঠিত বিধান সন্দেহের সুযোগ সব সময় আসামীরাই পাবেন। তাই ফৌজদারী মামলায় বেশীর ভাগ মামলা খালাস হয়। মামলা দায়ের করার সময় ও তদন্তের ভুলভ্রান্তির জন্য মামলা খারিজ হয়, আসামী খালাস পান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রতি দিন মিডিয়ার মাধ্যমে কড়া হুকুম দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল,পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ,আইনমন্ত্রী আনিসুল হকরা ’শুট এট সাইট’ বা দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ছয়জন ছাত্রজনতা হত্যার পর প্রতিমন্ত্রী আরাফাত বারবার মিডিয়ার মাধ্যমে বলেছেন আমরা সরকার, পুলিশবাহিনী আক্রান্ত,আন্দোলনকারীরা আক্রমণকারী। প্রকাশ্যে বলছেন আমরা আত্মরক্ষার জন্য গুলি করতে,খুন করতে পারি। পুলিশকে গণহত্যা অব্যাহত রাখার উসকানি বা নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি আইনের লোক নন,তিনি জানেন না যে আত্মরক্ষার অধিকারেরও একটা মাত্রা আছে। মাত্রার অতিরিক্ত অধিকার প্রয়োগ করলে নরহত্যার অপরাধ হয়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সলমান এফ রহমান ব্যবসায়ী নেতাদের সমবেত করে প্রধানমন্ত্রীকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন যাতে প্রধানমন্ত্রী ও হত্যাকারী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা গণহত্যা অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত হয়েছেন, প্ররোচিত হয়েছেন। আইনতঃ তাদের সকলকে এজাহারে আসামী করা যায়, এজাহার থেকে বাদ গেলেও অভিযোগপত্রে আসামী করা যাবে সহায়তা ও প্ররোচনা দানকারী হিসেবে।
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবুল হাসানকে হত্যা মামলার আসামী করা হয়েছে যখন তিনি খেলা উপলক্ষে কানাডায় ছিলেন বলে প্রকাশ। সাংবাদিক ফরজানা রূপা, তার স্বামী বা অন্যান্য সাংবাদিকদের যাদের হত্যা মামলায় আসামী করা হয়েছে তাদেরকে স্বৈরাচারের অতি প্রশংসার মাধ্যমে তোষামোদ করে স্বৈরশাসন ও লুটপাটতন্ত্র অব্যাহত রাখতে সহযোগিতা করে নিজেরা অবৈধ সুযোগ নিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান হয়ে কোটিপতি হয়ে অপরাধ করেছেন। সাকিবুল হাসানকে বা কথিত দোসর সাংবাদিকদের দুর্নীতি,মানিলন্ডারিং ইত্যাদির মামলায় আসামী করা যায়,কিšুÍ হত্যা মামলায় নয়। আগের আমলে পুলিশরা যেভাবে মিথ্যা, গায়েবী মামলা দায়ের করেছিল,এখনও কতিপয় পুলিশ অফিসারের কুপরামর্শে অধিক সংখ্যক মিথ্যা ও অস্বাভাবিক আসামী দেওয়া হচ্ছে বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্বভার কি নিজেদের পোশাক ও সরকারী অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যাওয়া পুলিশ অফিসারদের দেওয়া হবে? ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে অভিজ্ঞ,সৎ,নিরপেক্ষ ও পেশাদার হতে হবে। একইভাবে মামলা পরিচালনাকারী পাবলিক প্রসিকিউটরদেরও অভিজ্ঞ,সৎ,নিরপেক্ষ ও পেশাদার হতে হবে। আইন কর্মকর্তা বা পিপি কোন রাজনৈতিক দল বা অংগ সংগঠনের নেতা বা সদস্য হলে অবিলম্বে পদত্যাগ করে নিজের নিরপেক্ষতা জনসমক্ষে দৃশ্যমান করতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিচারককেও অবশ্যই স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে। তখনই ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে।
লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।